বাংলায় বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ হলো দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝেনা।আমরা হারালেই তাঁর মর্যাদা বুঝি।গতকাল চলে গেলেন বাংলাদেশের শীর্ষ আলেম,চট্টগ্রাম জামিয়া জিরির সম্মানিত পরিচালক আল্লামা শাহ তৈয়ব রহ।নির্মোহ,অহমিকাহীন এই অালেম চট্টগ্রামেএ সকল শ্রেণি পেশার মানুষের পরম বন্ধু ছিলেন।ইসলাম,দেশ মানবতার স্বার্থে সবার সাথে মিলে মিশে থাকতেন।তাঁর জীবন পর্যালোচনা করে আমার কাছে সব চেয়ে বেশি স্পেশাল মনে হয়েছে তাঁর কোন বিতর্কিত অধ্যায় নেই।সততা সরলতা,নিষ্ঠা যার জীবনের পরম অবলম্বন।টেকনাপ থেকে তেতুলিয়া তিনি ইসলামের সঠিক দর্শন মানুষের মাঝে পৌঁছে দিয়েছেন।তাঁর বয়ানে মানুষ সহজেই প্রভাবিত হত।
হৃদয়গ্রাহী, শ্রুতিমধুর বয়ান জুড়ে ছিল,আবেগ,অনুভূতি ভালোবাসার অনন্য প্রকাশ।চট্টগ্রামের অাঞ্চলিক ভাষায় তাঁর বয়ান ছিল খুবই চমৎকার।সহজ সরল, প্রাঞ্জল ও সাবলীল ভাষায় ছোট ছোট বাক্যে তিনি বয়ান করতে।প্রত্যন্ত অঞ্চল,অজপাড়া গাঁয়ের মানুষ থেকে শুরু করে শহরের স্মার্ট ও শিক্ষিত লোক তাঁর বয়ান সহজে বুঝতে পারত।ভাষার প্রাঞ্জলতা,অতুলনীয় উপমা,দরদ মাখা উপদেশে তিনি বয়ানে কখনো হাসাতেন আবার কখনো কাঁদাতেন।পরকাল,জাহান্নান কবর হাশর আর পুলসিরাতের কথা বলে তিনি নিজে কাঁদতেন, কাঁদতেন শ্রুতারাও।তিনি একজন কামেল পীর ছিলেন।তিনি খান্দানি পরিবারের সন্তান হয়েও কখনো অন্যদের বুঝতে দেননি।
ইসলামের সুমহান অাদর্শকে তিনি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে আজীবন প্রয়াস চালিয়েছেন।উম্মাহর প্রতি তাঁর দরদ ছিল অবর্ণনীয়। মিথ্যাকে ছেড়ে সত্যকে,অহংকার ছেড়ে নম্রতাকে,মরীচিকা ছেড়ে নিষ্ঠার সাথে বাঁচতে চেয়েছেন তিনি।পার্থিব ধন, সম্পদ,প্রভাব প্রতিপত্তির লোভে নিজের আদর্শ আর নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দেয়নি।যারা ইসলামের খেদমত করতেন তাদের প্রতি যথাসাধ্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন।কি দরদ মাখা ও কোমল কণ্ঠে বয়ান! যার বয়ান আমি তন্ময় হয়ে শুনতাম।মাঝে মাঝে আহ্ শব্দটি উচ্চারণে যেন কষ্ট উপচে পড়ত।এই কষ্ট নিজের জন্য নয়,উম্মার পথহারা,অাঁধারে নিমজ্জিত পাপী বান্দাদের জন্যে।তাঁর প্রধান মিশন ছিল আল্লাহ ভোলা মানুষকে অাল্লাহর পরিচয় করে দেওয়া। তিনি শাহ আবরারুল হক এর খলিফা ছিলেন।
আমি তাঁর সর্বশেষ বয়ান শুনেছি চট্টগ্রাম রেলওয়ে পলোগ্রাউন্ড মাঠে।সেটা ছিল মাত্র ১০ মিনিটের।বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটির আয়োজনে তিন দিন ব্যাপি মাহফিলের দ্বিতীয় দিন।অাকাশ থেকে অঝরধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল।বিশাল প্যান্ডেল ভেঙ্গে পড়ছে খন্ডখন্ড হয়ে।দ্বিতীয় দিন বাদ আছর তিনি ওলামা সম্মেলনের প্রতিকূল পরিবেশ বক্তব্য দেন।তিনি চরমোনাই তরিকান সাথে সবাইকে থাকার এবং পীর সাহেব চরমোনাইর কাজে সবাইকে সহযোগিতা করার আহবান জানান।মঞ্চে হুজুরের গায়ে বৃষ্টি পড়ছিল তবুও তিনি তাঁর বক্তব্য থামায়নি।যেখানে তাঁর বয়ানের দাওয়াত থাকত, আমি তাঁর বয়ান শুনতে চলে যেতাম।বুকে চড় মেরে আহ্ শব্দটি যেন এখনো আমার হৃদয়ে ধাক্কা মারছে।
তিনি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন।তিনি মাওলানা সৈয়দ ফজলুল করিম পীর সাহেব চরমোনাই রহ কে খুব ভালোবাসতেন।রাজনৈতিক অঙ্গনে যখন মরহুম পীর সাহেব যখন এক প্রকার কোনঠাসা হয়ে পড়েছিল তিনি তখন তাঁকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছিল।বর্তমান পীর সাহেব চরমোনাই ও নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম কে আপন সন্তানের মত ভালোবাসতেন।আর পীর সাহেব চরমোনাইও অভিভাবক মনে করে শায়েখের কাছে সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন।মায়াবি চাহনি,নির্মোহ মানসিকতা,শ্রুতিমধুর কথাশৈলী আর বাচনভঙ্গি সহজেই মানুষকে অাপন করে নিত।এমন সহজ সরল নির্লোভ, বুজুর্গ অালেম খুব কমই হয়।তাঁর মৃত্যুতে ইসলামী অঙ্গনে অপূরণীয় ক্ষতি হলেও তাঁর মৃত্যু ছিল পরম সৌভাগ্যের।নামাজে সিজদারত এমন মৃত্যু ক'জনের নসিবে জুটে? সারা মাস রোজা আর ইহতিকাফ শেষে অাল্লাহ তাঁর প্রিয় বন্ধুকে ঈদ করানোর জন্যে তাঁর সান্নিধ্যে নিয়ে গেলেন, এমনটাই মনে হয়েছে আমার কাছে।
লেখকঃনুর আহমেদ সিদ্দিকী
No comments:
Post a Comment